সারাদেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা!
বার্তাসেন্টার সংবাদদাতা
বৃহস্পতিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১, ২৩:১২বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফ হিসেবে কর্মরত চালক, গার্ড ও টিকিট চেকারদের অতিরিক্ত কাজের জন্য প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বাতিল হওয়া নিয়ে রেলওয়েতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আশঙ্কা রয়েছে সারাদেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ার।
গত ৩ নভেম্বর রেলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ১৬২ বছর ধরে পাওয়া মাইলেজ সুবিধাদি বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে নির্ধারিত আট ঘণ্টার বেশি ডিউটি পালন করতে অপারগতা প্রকাশ করেন রেলের চালক, গার্ড ও টিকিট চেকাররা।
আগামী ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দাবি না মানলে পরদিন থেকে কর্মঘণ্টার বাইরে কাজ বন্ধ রাখার ঘোষণাও দিয়েছেন তারা। রানিং স্টাফদের মতে, তীব্র জনবল সংকটের কারণে তাদের প্রত্যেক স্টাফকে নির্ধারিত আট ঘণ্টা সময়ের চেয়ে প্রতিদিন ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। এক দিনের জন্য তারা অতিরিক্ত কাজ বন্ধ করে দিলে সারাদেশে রেল যোগাযোগে বিপর্যয় নেমে আসবে।
রেলের শ্রমিক নেতারা বলেন, সমস্যার সমাধান না হলে ২৬ ডিসেম্বর থেকে কর্ম বিরতিতে যাবেন তারা। তবে দ্রত সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন রেলমন্ত্রী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাইলেজ সুবিধা বাতিল হওয়ার পর থেকে রেলের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রী সচিবদের কাছে ধারণা দিয়েছেন। সর্বশেষ বুধবার এ বিষয়ে রেল ভবনে চালক, গার্ড ও টিকিট চেকারদের কয়েকজন প্রতিনিধিকে ডেকে পাঠান রেলের যুগ্ম মহাপরিচালক (মেকানিক) মৃণাল কান্তি। দিনভর রেল ভবনে এই নিয়ে মিটিং হলেও কোনো সমাধানের পথ খুঁজে পায়নি উভয় পক্ষ। এরপর থেকেই মূলত রানিং স্টাফরা জোরাল আন্দোলনের পথে পা বাড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্রিটিশ আমল থেকে চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালন করা চালক, গার্ড ও টিকিট চেকারদের বিশেষ আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। প্রতি ১০০ মাইল ট্রেন চালালে দেওয়া হয় মূল বেতনের এক দিনের সমপরিমাণ অতিরিক্ত টাকা। পেনশনের সঙ্গেও দেওয়া হয় বাড়তি ৭৫ শতাংশ টাকা।
তারা জানান, ট্রেনের চাকা সচল রাখতে একজন চালককে প্রতিদিন কাজ করতে হচ্ছে। কোনো সাপ্তাহিক ছুটি না নিয়ে তারা দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা সচল রাখছে রেল। এমনকি ঈদের দিনও তাদের কাজ করতে হয়। তাহলে তাদের এত দিনের সুবিধা বাতিল করা হবে কেন? এতে ক্ষুব্ধ রানিং স্টাফরা ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ না করার ঘোষণা দেওয়ায় ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এদিকে রেলওয়ে আইনের ১৬৮৫/১০৮৫ বিধি অনুযায়ী, ট্রেন চালক, গার্ড ও ট্রেন টিকিট পরীক্ষকরা (টিটিই) রানিং স্টাফ। তারা নির্ধারিত ডিউটির পাশাপাশি কর্মরত অবস্থায় যত দূরত্ব পর্যন্ত ট্রেন চালাবেন, সে হিসাবে মাইল গুণে বাড়তি ভাতা পাবেন। রেলওয়ে আইনে সাপ্তাহিক বা সরকারি বন্ধের দিনে ডিউটি করলে হলিডে মাইলেজ প্রাপ্তির বিধানও রয়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকে এ বিধান চলে আসছে।
এছাড়া ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর এক অনুশাসনে তাদের মাইলেজ (রেলের আইন অনুযায়ী) পাওয়ার কথা বলা রয়েছে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বিগত দিনে রানিং স্টাফরা রেলে ঘণ্টা হিসেবে প্রতি এক মাসে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন বাবদ তাদের প্রতি মাসের বেতনের চেয়েও আড়াই থেকে তিন মাসের সমপরিমাণ অর্থ ভাতা হিসেবে উত্তোলন করছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের বেসামরিক কর্মচারীদের অতিরিক্ত ভাতা পাওয়ার সুযোগ নেই মর্মে, অর্থ-মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে বলা হয়, রানিং স্টাফরা যতই ডিউটি করুক তাদের শুধু সরকার নির্ধারিত এক মাসের সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করা হবে। এছাড়া অবসরকালীন ভাতার বাড়তি ৭৫ শতাংশ টাকাও বাতিল করা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই সিদ্ধান্ত জানার পর মাইলেজ সুবিধা চালুর দাবিতে নিয়মিত বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সভা করছেন চালক, গার্ড (ট্রেন পরিচালক) ও টিকিট চেকারেরা। তারা রেলমন্ত্রী, রেলওয়ের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি একাধিক সভাও করেছেন।
আগামী ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দাবি না মানলে পরদিন থেকে কর্মঘণ্টার বাইরে কাজ বন্ধ রাখার ঘোষণাও দিয়েছেন রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক-কর্মচারী সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান। তারা রেলমন্ত্রী, রেলওয়ের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি একাধিক সভাও করেছেন।
একটি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে রেলের রানিং স্টাফদের দেওয়া মাইলেজ সুবিধাকে বিশেষ সুবিধা বিবেচনায় মূল বেতন-ভাতা প্রদানের পরবর্তী মাসে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেলওয়ে। ওই সময় রানিং স্টাফরা আন্দোলনের মাধ্যমে মাইলেজ সুবিধা আবার আদায় করেন।
১৯৯৭ সালের ১ জুলাই থেকে মূল বেতনের ভিত্তিতে রানিং অ্যালাউন্স প্রদানের প্রস্তাব হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রানিং স্টাফদের বিশেষ এ ভাতা প্রদানের প্রস্তাব ১৯৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি অনুমোদন করেন।
রেলের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিভিন্ন পদে নিয়োগ বন্ধ থাকায় রেলের তীব্র জনবল সংকট চলছে বহুদিন ধরে। বর্তমানে সারাদেশে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ট্রেন চালকের বিপরীতে মাত্র এক হাজার চালক দিয়ে রেল যোগাযোগ সচল রয়েছে। এর মধ্যে আবার প্রতি বছরই কোনো না কোনো চালকের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তখন তাদের আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে ট্রেন চলাচল সচল রাখছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
এ অবস্থায় রেলে নতুন নিয়োগ না দিয়ে এমন পদক্ষেপে রানিং স্টাফদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, এ মাসে সারাদেশে ট্রেন চলাচল বিপর্যয় নেমে আসবে। কেননা স্টাফরা তাদের নির্ধারিত ৮ ঘণ্টা ডিউটি পালন করলে বাকি সময় লোকবল সংকটে ট্রেন লাইনে গড়াবে না।
আমাদের আরও সংবাদ পড়ুন: সেলিনা হায়াৎ আইভী কে জেতাতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর।
রেলের তথ্য বিভাগে যোগাযোগ করে জানা গেছে, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে দ্রত সমাধান বের করার চেষ্টা করছেন। সমাধান যাই আসুক, সবাই জানতে পারবে বলে জানিয়েছেন তথ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক-কর্মচারী সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, ব্রিটিশরাই রেলওয়ের রানিং কর্মচারীদের জন্য বিশেষায়িত এ সুবিধা দিয়ে এসেছে। ১৯৯৭ সালে সরকার এটিকে নির্দিষ্ট করে ‘পার্ট অব পে’ ঘোষণা করেছে। এখন এটা বন্ধ করা রেলের স্টাফদের সঙ্গে প্রহসনের শামিল।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজা গণমাধ্যমকে বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে রেলওয়ের রানিং স্টাফরা অতিরিক্ত কাজের ভাতা পেত। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ট্রেন চালকসহ সংশ্লিষ্টরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ক্ষোভ বিরাজ করছে সবার মধ্যে। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। মন্ত্রী কাজ করছেন। আশা করি, শিগগিরই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
Comments