ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা শুরু করেছে রাশিয়া

বার্তাসেন্টার সংবাদদাতা

রবিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:৪৩

ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা চালাতে শুরু করেছে রাশিয়া। গতকাল বৃহস্পতিবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশের পর এই সামরিক হামলা চালানো হয়। কিয়েভের তিন দিক ঘিরে ফেলেছে মস্কো। সেনা ও বিমান বাহিনী হামলায় যোগ দিয়েছে। ইউক্রেনের বড় বড় শহর ও সামরিক ঘাঁটিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা

এ হামলায় দুই দেশের ৯০ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ইউক্রেনের ৪০ সেনাসহ অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছে। আর ইউক্রেনের সেনারা ৫০ রুশ সেনাকে হত্যার দাবি করেছে। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট সবাইকে অস্ত্র হাতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ বিশ্ব নেতারা হামলার জন্য রাশিয়াকে এককভাবে দায়ী করেছে এবং আরো নিষেধাজ্ঞার হুশিয়ারি দিয়েছে।

তবে প্রেসিডেন্ট পুতিন হুশিয়ারি দিয়েছেন, বাইরের কোনো শক্তি এই লড়াইয়ে জড়ালে তাকে এমন শিক্ষা দেওয়া হবে যা ঐ দেশটি কোনোদিন দেখেনি। রাশিয়ার সামরিক হামলায় ইউরোপজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনেকে গতকালকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের জন্য সবচেয়ে অন্ধকার দিন বলে উল্লেখ করেছেন। আর সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, ইউক্রেনে এখন নিরাপদ কোনো স্হান নেই।

হামলার নির্দেশ পুতিনের, পেছনে যে যুক্তি
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর ৫টায় প্রেসিডেন্ট পুতিন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তিনি ইউক্রেনে সেনা অভিযান চালানো হচ্ছে বলে তাকে জানান। লুকাশেঙ্কোর কার্যালয় এই খবর নিশ্চিত করে জানিয়েছে, ‘পুতিন রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদী নিয়ন্ত্রিত ডনবাস অঞ্চলের পরিস্হিতি জানান এবং বলেন যে জাতিসংঘ সনদের সপ্তম অধ্যায়ের ৫১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আমি সেখানে একটি বিশেষ সামরিক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি’।

ইউক্রেন আর রুশ বাহিনীর মধ্যে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী ও সময়ের ব্যাপার উল্লেখ করে পুতিন বলেন, ন্যায়বিচার ও সত্য রাশিয়ার পক্ষে রয়েছে। তিনি সতর্ক করেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে কেউ পদক্ষেপ নিলে এমন শিক্ষা দেওয়া হবে যা কোনোদিন কেউ দেখেনি। পুতিন এমন সময় ইউক্রেনে সেনা অভিযানের নির্দেশ দেন যখন নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক চলছিল। মস্কোর স্হানীয় সময় ভোর ৫টা ৫৫ মিনিটে ইউক্রেনে সেনা অভিযান চালানোর ঘোষণা দেন তিনি। এর কয়েক মিনিট পরেই ইউক্রেনে বোমা এবং মিসাইল হামলা শুরু হয়। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে জরুরি সাইরেন বাজানো হয় এবং মহাসড়কগুলোতে ছিল শহর ছেড়ে যেতে চাওয়া মানুষের গাড়ির ভিড়।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ হামলার পেছনে যুক্তি দিয়ে জানিয়েছেন, ইউক্রেনের লুহানস্ক ও দোনেত্স্ক পিপলস রিপাাবলিকের দুই নেতা ডেনিস পুশলিন ও লেওনিড পাসেশনিক রাশিয়ার কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, ইউক্রেনের সেনা সেখানে সমানে আগ্রাসন চালাচ্ছে। তা ঠেকাতে গেলে রাশিয়ার সামরিক সাহায্য দরকার। পেশকভ জানিয়েছেন, দুই বিদ্রোহী নেতা পুতিনকে লিখেছেন যে, ইউক্রেনের সেনা প্রবল গোলাবর্ষণ করছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছেন। এই দুই নেতার মতে, ইউক্রেন যে ডনবাসে যুদ্ধ থামাতে চাইছে না, তা তাদের এই আচরণ থেকেই স্পষ্ট।

তিন দিক থেকে সর্বাত্মক হামলা
রুশ বাহিনী কয়েকটি দিক থেকে ইউক্রেনে ঢুকে পড়ে। ইউক্রেন বলছে, রুশ সেনাবাহিনীর যানবাহন উত্তরে বেলারুশ ও দক্ষিণে ক্রিমিয়া ছাড়াও বেশ কয়েকটি অংশ দিয়ে ইউক্রেনে প্রবেশ করেছে। রুশ সেনাবাহিনীর বহর ইউক্রেনের উত্তরে চেরনিহিভ ও সুমি অঞ্চল দিয়ে এবং পূর্বাঞ্চলে লুহানস্ক ও খারকিভ অঞ্চল দিয়ে দেশটির ভেতরে প্রবেশ করেছে বলে জানাচ্ছে ইউক্রেনের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, ডিপিএসইউ। ডিপিএসইউ জানায়, কামানের গোলা চালানোর পর রুশ সেনাবাহিনী সীমান্তের ভেতরে আগ্রাসন শুরু করে।

সংস্হাটি জানিয়েছে, ইউক্রেনের সীমান্তরক্ষী ও সশস্ত্র বাহিনী শত্রুকে প্রতিহত করতে সব পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাশিয়া পুরোদস্ত্তর হামলা চালিয়েছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রুশ সেনাবাহিনী ইউক্রেনের পূর্বে তীব্র বোমা হামলা শুরু করেছে। ঐ বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, কিয়েভের কাছে বরিস্পিল বিমানবন্দরসহ একাধিক বিমানবন্দরে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। রুশ বিমান হামলা প্রতিহত করতে ইউক্রেনের বিমান বাহিনী লড়াই করছে বলে বলা হয়েছে ঐ বিবৃতিতে। ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের বন্দর নগরী ওদেসায় রুশ প্যারাট্রুপার নামার খবর অস্বীকার করা হয়েছে ঐ বিবৃতিতে।

ইউক্রেনে যুদ্ধ

ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে স্হানীয় গণমাধ্যম জানায়, কিয়েভে দেশটির সেনাবাহিনী হেডকোয়ার্টারে এবং মিসাইল কমান্ড সেন্টারে মিসাইল হামলা চালানো হয়েছে। ইউক্রেনের শহরে আক্রমণ চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, তারা দেশটির সেনা স্হাপনা, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্হা ও বিমান বাহিনীর ওপর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্ত্ততে আঘাত করতে সক্ষম অস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কিয়েভ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং দেশটির পশ্চিমে ইভানো-ফ্র্যাকিভস্ক বিমানবন্দর।

ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে গতকাল বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। তবে কিছু কিছু বিস্ফোরণের সংবাদের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রাজধানী কিয়েভসহ দোনেত্স্ক অঞ্চলের ক্রামাতর্সকে বিস্ফোরণের খবর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খারকিভ, দক্ষিণের ওদেসা এবং পূর্বাঞ্চলের দোনেত্স্ক ওবলাস্ত এলাকায় বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে।

ব্রিটিশ গোয়েন্দারা জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ইউক্রেনে ৮০ টির বেশি হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। কিয়েভের কাছে একটি বিমান ঘাঁটি রাশিয়ার সৈন্য দখল করেছে বলে জানা গেছে। এক ভিডিও ফুটেজে পূর্ব ইউক্রেনের খারকিভ অঞ্চলের কাছে চুগুয়েভ সামরিক বিমান ঘাঁটিতে আগুন ও কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। সূত্র অজানা হলেও ফুটেজের সত্যতা যাচাই করা গেছে।

রাশিয়া থেকে রকেট হামলা চালানোর খবরও পাওয়া গেছে। মস্কো দাবি করেছে, বৃহস্পতিবারের সেনা অভিযানে ইউক্রেনের অন্তত ৭৪টি সামরিক স্হাপনা ধ্বংস হয়েছে। ইউক্রেনের পুলিশ জানায়, দেশজুড়েই রাশিয়ার হামলা শুরু হয়েছে। তারা রুশ হামলার অন্তত দুই শতাধিক নির্দশন দেখতে পেয়েছেন।

ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে একাধিক খবর প্রকাশ করা হচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে যে প্রতিবেশি দেশ বেলারুশের সেনারাও রাশিয়ার সেনাদের সঙ্গে অভিযানে যোগ দিচ্ছে। এদিকে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, তাদের সৈন্য রাশিয়ার সঙ্গে যোগ দিতে পারে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেলারুশকে এই সেনা অভিযানে যোগ না দিতে আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্লেষকরা বেলারুশকে রাশিয়ার ‘মক্কেল রাষ্ট্র’ হিসেবে বলে থাকেন।

যতো মানুষ হতাহত হয়েছে
ইউক্রেন জানিয়েছে, তাদের অন্তত ৪০জন সৈন্য মারা গেছে এবং ৩০ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ মারা গেছে। এর মধ্যে ওডেসা বন্দরের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত ১৮ জন মারা গেছে বলে বলা হচ্ছে। পাশাপাশি ইউক্রেন সেনাবাহিনী দাবি করেছে তারা প্রায় ৫০জন রুশ দখলদারকে গুলি করে হত্যা করেছে এবং ছয়টি রুশ বিমান গুলি করে নামিয়েছে, যদিও নিরপেক্ষভাবে এ দাবি যাচাই করা যায়নি।

পূর্ব ইউক্রেনেও তুমুল লড়াই হচ্ছে বলে খবর আসছে। দেশটির দ্বিতীয় বড় শহর খারকিভের বাসিন্দারা বলছেন দুই পক্ষের মধ্যে গোলা বিনিময় এবং অনবরত বিস্ফোরণে তাদের ভবনের জানলাগুলো কাঁপছে। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ১৯৩৯ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ এখন সবচেয়ে বেশি অন্ধকার সময়ের মধ্যে আছে।

ইউক্রেন গতকাল জানায়, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অত্যধিক ঝুঁকির কারণে বেসামরিক বিমান চলাচলের জন্য তারা তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে ইউরোপের বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রক সংস্হা, সামরিক কার্যকলাপের কারণে রাশিয়া ও বেলারুশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় বিমান চলাচলের ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করেছে। গত মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট পুতিনের নির্দেশের পরই রুশ সেনা ও ট্যাংক পূর্ব ইউক্রেনে প্রবেশ করে।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *